চিরতরুণ ডা. তরুন তপন বড়ুয়া

ডাক্তার তরুন তপন বড়ুয়া সন্ধানীর ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম, আর সন্ধানীয়ানদের কাছে এক আশ্রয় দাতা – বটবৃক্ষ।

১৯৭০ সালের ২৫ মে মা বাসন্তিকা বড়ুয়া এবং বাবা অচিন্ত্য কুমার বড়ুয়ার কোল জুড়ে প্রথম সন্তান হিসেবে পৃথিবীতে আসেন তিনি। বাবা-মা উপযুক্ত নাম ই রেখেছিলেন, তরুন। স্বল্প আয়ুর এ জীবনে নিজেকে বয়সের বাঁধনে বাঁধতে দেন নি। এই ক্ষুদ্র জীবনের অনেকটা সময়ই কেটে গেছে মানুষের জন্য ।

শৈশবে প্রথমে বাকলিয়া সরকারি স্কুল এরপর চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যয়নের মাধ্যমে শেষ করেন উচ্চ মাধ্যমিক।১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৩০ তম ব্যাচে ভর্তি হন।

মেডিকেল জীবন থেকেই শুরু হয় সন্ধানীর সাথে তাঁর ৩০ বছরের এই পথ চলা। সন্ধানী চমেক ইউনিটের কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সাথে।

১৯৯১ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাড়াতে দিনরাত সন্ধানীর কর্মী হিসেবে শ্রম দিয়ে গেছেন। চকরিয়ায় মেহেরনামা স্কুল প্রতিষ্ঠাকালীন সময়েও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সন্ধানী তে যেমন দিয়েছেন শ্রম তেমনি উপদেষ্টা হয়ে অনুজদের দেন দিক নির্দেশনা। তাঁরই হাত ধরে সন্ধানীতে শুরু শিক্ষাবৃত্তি। মানবতার স্বার্থে দান করে গেছেন বিভিন্ন সময়। সন্ধানীতে দান করেন এসি, বিভিন্ন সময় ত্রানের জন্য দান করেন অর্থ। আয়োজন করেন অসংখ্য রক্তদান কর্মসূচি, ফ্রি হেলথ ক্যাম্প।

শুধু সন্ধানীই নয় তিনি কাজ করে গেছেন আরো অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে।জড়িত ছিলেন RISSHO KOSEI-KAI, রোটারী ক্লাব, উপলব্ধি, CMC ON FB এর মত আরো অনেক সংগঠনের সাথে, যার মাধ্যমে কাজ করে গেছেন গরীব, দুঃস্থ, ছিন্নমূল, প্রতিবন্ধী ও পথশিশুদের জন্য। তিনি আমৃত্যু চিন্তা করে গেছেন মানুষের জন্য। চট্টগ্রামের দূর্গম এলাকা থেকে শুরু করে শহর ও গ্রামে বিভিন্ন জায়গায় অগণিত ফ্রি হেলথ ক্যাম্প করে গেছেন যার মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা এবং ঔষধপত্র পেয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।

সন্ধানীয়ানরা যে কোনো কাজে যেমন তাঁকে পেয়েছেন একান্ত নিজেদের করে তেমনি সন্ধানীর যে কোনো সমস্যায় পেয়েছেন ঢাল হিসেবে। বইয়ের পাতার আদর্শ মানুষের বাস্তব রূপ ছিলেন তিনি। সময়ানুবর্তিতা, সততা, স্পষ্টভাষীতা, মমতার এক অপুর্ব মিশ্রন ছিলেন তিনি।

২০১৯ সালে হঠাৎ এ মহান মানুষটি আক্রান্ত হন দুরারোগ্য রোগ T cell acute lymphoblastic leukemia তে। কেমোথেরাপির মত চিকিৎসার পরও তাঁর মনোবল ছিল অটুট। সন্ধানীর প্রতিটি সদস্য অপেক্ষায় থাকতো, এই বুঝি তিনি সুস্থ হয়ে আবার আসবেন আমাদের মাঝে। কিন্তু সে সুযোগ স্রষ্টা আমাদের ভাগ্যে রাখেন নি। ২২ জুন Irreversible cardiorespiratory failure এ উত্তর বন্দর, ২নং ওয়ার্ড, মহালখান বাজার, কর্ণফুলী থানায় নিজ বাসভবনে সকাল ১০ টা ৩০ তিনি আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমান পরলোকের উদ্দেশ্যে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি KAFCO এর Chief Medical Officer হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মৃত্যুকালে রেখে যান স্ত্রী ডালিয়া বড়ুয়া এবং তাঁর স্মৃতি হিসেবে ২ কন্যা, ১ পুত্র সন্তানকে। রেখে যান অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী এবং তাঁর মহৎ কর্মজীবন।

তিনি এমন এক মানুষ মৃত্যুতেই যার জীবন থেমে যায়নি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এনাটমি ডিপার্টমেন্টে করে গেছেন মরোণোত্তর দেহদান, যেন তাঁর মাধ্যমেই আরো অনেক শিক্ষার্থী দীক্ষা অর্জন করতে পারে মানবতার পেশার।

তিনি সন্ধানীতে মরণোত্তর চক্ষুদাতা হিসেবে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। তবে লিম্ফোমায় আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর কর্নিয়া অন্য কোন ব্যক্তির চোখে সংযোজন করা সম্ভব ছিল না বলে কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয়নি।

শোক প্রকাশের ভাষা আমাদের নেই, তাই স্মৃতি রোমন্থন করেই দিন কাটে আমাদের।

প্রিয় তরুন দাদা, আপনি যুগ যুগ ধরে থেকে যাবেন সন্ধানীর ইতিহাসে, আপনি থাকবেন প্রতিটি সন্ধানীয়ানের মনের গহীনে। আমরা প্রত্যেক নবাগতদের শোনাব আপনার কীর্তিগাথা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *